নক্ষত্রের জন্ম ও বিবর্তন - কোয়াসার, আমাদের সূর্যের পরিণতি


নক্ষত্রের জন্ম ও বিবর্তন - কোয়াসার, আমাদের সূর্যের পরিণতি

লেখকঃ অদ্বিত কান্তি রাউৎ
.
কোয়াসারঃ- Quasar শব্দটি “Quasi Stellar Radio Sources” শব্দগুচ্ছের সংক্ষিপ্ত রূপ। মূলত এরাই হল নক্ষত্রের মত বিন্দুবৎ রেডিও উৎস। কিন্তু পরে এমন অনেক কোয়েসার পাওয়া গিয়েছে যাদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য রেডিও বিকিরন নেই। তাই সাধারণভাবে এদেরকে Quasi Steller Objects বা সংক্ষেপে QSO বলে। কোয়েসারদের কৌনিক ব্যাস ১” এর কম। তাই পৃথিবী থেকে তোলা আলোকচিত্রে এদেরকে নক্ষত্রের মত অবিশ্লেষিত অবস্থায় দেখা যায়।

কোয়েসারের সবচেয়ে অবাক করা বৈশিষ্ট্য হল এই যে, আকাশের খুব চোট একটি অঞ্চল তেকে একটি গ্যালক্সির একশ গুনের বেশী বিকিরন পাওয়া যায়।সৌরজগতে প্লুটোর বক্ষপথের ব্যাস যতোটা তার চেয়ে সামান্য বড় এলাকা থেকে একটি কোয়েসার যে পরিমান শক্তি বিকিরণ করে তা আমাদের আকাশ গঙ্গা গ্যালাক্সির মত কোটি কোটি গ্যালাক্সির বিকিরনের সমান। এমন বিপুল শক্তি বিকিরনের মাত্র একটিই ব্যাখ্যা দেয়া যায়। সে হল কৃষ্ণগহ্বর। এরকম একটি কৃষ্ণগহ্বরের ভর হতে পারে ১০৯ সূর্যভর যা ক্রমাগত চারপাশ থেকে বস্তু শুষে নিয়ে তার জ্বালানীর পরিমান বাড়িয়ে চলে। আর একবার এর সংযুক্তি চাকতির মধ্যে পড়লে, সেসব বস্তু প্রচন্ডরকম বেগবান হতে হতে অবশেষে আলোর বেগ লাভ করে। আর তাতে এমন বিপুল শক্তি সৃষ্টি হয় যে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ঢুকে যাবার আগে তা থেকে তীব্র গামা রশ্মি ও এক্স-রে রশ্মির আকারে তেজ বিকিরিত হতে থাকে।কখনো কখনো কৃষ্ণগহ্বরেরা এত বেশী বস্তু গিলে ফেলে, যা তারা পুরোপুরি হজম করতে পারে না। সেক্ষেত্রে বাড়তি বস্তু সংযুক্তি চাক্তির সঙ্গে সমকোনে অর্থাৎ কৃষ্ণগহ্বরের দুই মেরু থেকে দু’টি সরু ধারায় ছিটকে বেরোতে থাকে।

আমরা জানি যে প্রায় প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে বিশাল ভরবিশিষ্ট Black Hole রয়েছে। ধারনা করা যায় যে প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই কোনো এককালে কোয়েসার ছিল। দু’টি গ্যালাক্সির সংঘর্ষের ফলে কোয়েসার জন্ম নিতে পারে। এক্ষেত্রে যে গ্যালাক্সিদ্বয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে, তাদের মধ্যে যেটি বেশী ভারী, সেটির কেন্দ্রস্থ অতিভারী কৃষ্ণগহ্বর অপর গ্যারাক্সির সকল নক্ষত্র ও গ্যাস আত্মসাৎ করতে থাকে। প্রতি বছর পৃথিবীর ভরের দশ লক্ষ গুন বস্তু গিলে খাবার ফলে কিছুদিনের মধ্যে তার ভর সূর্যেরে ভরের চেয়ে বহুলক্ষ বা বহুকোটি গুন বড় হয়ে উঠে। সূর্যের ভরের চেয়ে ১০০ কোটি গুন ভরের কৃষ্ণগহ্বর হলে তার ব্যাস হবে প্লুটোর কক্ষপথের ব্যাসের মত তখন সেটা হয়ে উঠবে একটা কোয়েসার।

যখন কৃষ্ণগহ্বর অতি সক্রিয় হয়ে উঠে তখন বিকিরনের তোড়ে তার চারপাশের বস্তু দূরে ছিটকে যেতে থাকে। তাতে সে কৃষ্ণগহ্বরের বস্তুরে পুঁজিতে টান পড়ে, তার তেজ কমে আসে। কিছুপরে চারপাশ থেকে বস্তু আবার এসে জড়ো হয়। তখন তার তেজ আবার বেড়ে ওঠে। এভাবে একটা সময় আসে যখন কৃষ্ণগহ্বরের তেজ আর ঠিক আগের পর্যায়ে পৌঁছায় না। তখন কোয়েসারের আয়ু শেষ হয়ে আসে। সম্ভবত, কোনো কোয়েসারই দুইশ কোটি বছরের বেশী টিকে থাকতে পারে না। এযাবৎ সবচেয়ে দূরে যে কোয়েসার দেখা গিয়েছে সে আমাদের কাছ থেকে ১২০০ কোটি আলোক বছর দূরে। অধিকাংশ কোয়েসার এত বেশী দূরে দেখা যায় যে তাকে বিজ্ঞানীরা মনে করেন মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর প্রথম কয়েকশ কোটি বছর সম্ভবত কোয়েসারের সংখ্যা আজকের তুলনায় অনেক বেশী ছিল। তারপর কোয়েসার সৃষ্টির হার বেশ কিছুটা কমে এসেছে।

আজ আমরা মহাকাশে যেসব কোয়েসারের আলোর মশাল দেখতে পাচ্ছি, তা মোটেই তাদের আজকের চেহারা নয়। বহুকোটি বছর আগে তারা যে তীব্র দ্যুতি মহাশূন্যে ছুড়ে দিয়েছিল তাই সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে বহুকাল পরে আজ এসে আমাদের চোখে পড়েছে। হয়তো সে তাদের একেবারে কৈশোরের বা যৌবনের আলো।

শেষ কথাঃ রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশ আমার চিরকালের প্রিয় বস্তু। যখন আমি আমার বাসার ছাদে উঠে তারাভরা আকাশের দিকে তাকাই, মন হারিয়ে যায় এক সুবিশাল ব্যাপ্তিতে। ব্যাপ্তির এই এক রহস্যময় আকর্ষণ রয়েছে। আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে, “রহস্যই সর্বাপেক্ষা সৌন্দর্যের প্রতীক। এই অনুভূতির সাথে যার পরিচয় ঘটেনি, অনন্ত রহস্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও যার মন অপার বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয় না, ধরে নিতে হবে তার চোখ এবং মন দুয়েরই মৃত্যু হয়েছে।” আর, মহাকাশই হল সকল রহস্যের আধার। গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, তারা, উল্কা, ধুমকেতু, পালসার, কোয়েসার, ব্ল্যাক হোল, ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি, এলিয়েন কি নাই মহাকাশে। আমরা মানুষ নিজেদেরকে সৃষ্টির সেরা জীব বলে দাবী করি। কিন্তু কত অজানা জাতি, মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান কত অজানা সভ্যতা মহাকাশের গভীরে লুকিয়ে আছে, কে জানে?

আজ হতে ৫০০ কোটি বছর পর, যখন আমাদের সূর্য লাল অতি দানব তারায় পরিণত হবে, তখন পৃথিবীসহ নিকটস্থ গ্রহসমূহকে গ্রাস করবে এবং একসময় শ্বেত বামনে পরিণত হবে। সেসময় যদি অন্য কোনো নক্ষত্রিক সভ্যতা মহাকাশযানে করে সেই শ্বেতবামন তারাটির নিকট আসে অর্থাৎ আমাদের সৌরজগতে আসে। তারা কোনটিন জানতেও পারবে না, কোন এককালে এখানে পৃথিবী নামে কোন গ্রহ ছিল আর সে গ্রহে এমন বুদ্ধিমান প্রাণী ছিল, যারা কিনা মহাবিশ্বর উৎপত্তি ও নিয়তি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সক্ষম। সকল কিছুই একদিন মহাকালের স্রোতে ভেসে মহাকাশে বিলীন হয়ে যাবে। তারারাও এর ব্যতিক্রম নয়। মহাবিশ্বের শুরুর দিকে বিশাল ভরবিশিষ্ট তারারা জন্মগ্রহণ করত। এরপর জন্মানো শুরু করে মাঝারি আকৃতির তারাসমূহ (আমাদের সূর্যের মত) এবং শেষ পর্যন্ত কেবলমাত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তারাগুলো জন্মাবে। মহাবিশ্বে তারার জন্মের জন্য যে পরিমাণ হাইড্রোজেন গ্যাস মজুদ আছে, তা আগামী কয়েক ট্রিলিয়ন বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর, আর কোন নতুন তারা জন্মাবে না। মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে অন্ধকার ও শীতল হয়ে যাবে। এখনই হল জীবনের উপযুক্ত সময়। মহাবিশ্বের জন্য এবং পৃথিবীর মানুষের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। কারণ, বর্তমানে নীহারিকাপুঞ্জ থেকে ক্রমাগত নতুন তারার জন্ম হচ্ছে। তারা জীবনকে বিকশিত করছে এবং মহাবিশ্বের নিকষ কালো অন্ধকার দূর করছে আলোর মাধ্যমে।

এসো বন্ধুগণ, সমস্ত দুঃখ, ব্যাথা, বেদনা, কষ্ট মুছে ফেলে এসো আমরা আমাদের এই ছোট জীবন সূর্যের সাথে উপভোগ করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন